জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত ১৭ জানুয়ারি নিউইয়র্কে কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীগণের সাথে নতুন বছরের কর্মকৌশল উপস্থাপনের পাশাপাশি গত বছরের অর্জন নিয়ে আলোকপাতকালে বলেন, করোনা মহামারি ও অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে সারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষা-ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আরও গভীরভাবে অনুভূত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা কাজে লাগিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনগুলোকে আরো কীভাবে ত্বরান্বিত করা যায় সে বিষয়ে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের সাথে কাজ করে যাব। স্থায়ী প্রতিনিধি তার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করব। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে সকল যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন সেগুলো বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা অর্জনে কাজ করে যাব’।
রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, জনস্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, পানি নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা, সমুদ্র আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিবাসন সংক্রান্ত বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরব এবং সংরক্ষণে কাজ করে যাব।
বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে গণমাধ্যম-কর্মীগণের সাথে রাষ্ট্রদূত মুহিতের এটি ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক মতবিনিময়। উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। মিশনের কাউন্সিলর (প্রেস) নাসির উদ্দিনের সঞ্চালনায় রাষ্ট্রদূতের সাথে শুভেচ্ছা মিনিময় অনুষ্ঠানের মঞ্চে ছিলেন উপস্থায়ী প্রতিনিধি ড. মনোয়ার হোসেন। রাষ্ট্রদূত মুহিত এ সময় বলেন, আমরা বছরব্যাপী চেষ্টা করেছি জাতিসংঘে আমাদের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম, অবদান বা অর্জনকে আপনাদের নিকট পৌঁছাতে বা সেগুলো আপনাদের মাধ্যমে কভার করাতে। আমাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ আরও বৃদ্ধির জন্য আমরা এ বছরও সচেষ্ট থাকবো। আমরা এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি এবং আরও বেশি সহযোগিতা পাওয়ার আশা রাখছি।
রাষ্ট্রদূত মুহিত বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর ৫০ বছর পূর্তি হবে ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। আমরা এই উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পালনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এ বছরের শেষার্ধ হতেই কাজ শুরু করব।
রাষ্ট্রদূত মুহিত বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, কিন্তু পরিবেশগত কারণে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না।
স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত বলেন, ২০২২ সালে মিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আমাদের নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ, আফগানিস্তান সংকটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখেও আমরা আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়টি আলোচনায় রেখেছি। সাধারণ পরিষদে এবার আমরা গতবছরের চাইতেও জোরালো একটি প্রস্তাব এনেছি যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়েছে। প্রস্তাবটি ১০৯ টি দেশ কো-স্পন্সর করেছে যা ২০১৭ সাল থেকে এ যাবত সর্বোচ্চ।
রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, গত ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো “মিয়ানমারের পরিস্থিতি” বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মিয়ানমারের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জরুরি অবস্থা, বন্দি মুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রস্তাবটির ওপর ভোট আহবান করা হলে তা ১২-০ ভোটে অনুমোদিত হয়।
উল্লেখ্য, এই প্রস্তাবনার বিপক্ষে কোনো সদস্য ভোট দেয়নি অথবা কোন স্থায়ী সদস্য ভেটো প্রদান করেনি। বলা বাহুল্য, এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের প্রতি জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গটির শক্তিশালী সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে গৃহীত প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আরও সুসংহত করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করা হয়। পরিষদ রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবসনের নিমিত্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে আহবান জানায়। মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা যে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে, সে বিষয়টি দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয়। এছাড়া, এ সমস্যার সমাধানে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ২০২১ সালে গৃহীত পাঁচ দফা ঐক্যমত্যের দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং এর বাস্তবায়নে জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হবে কিনা সে বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতকে আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রতিবেদন পেশ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন প্রস্তাবটিতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত জানান, গত ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাব সন্নিবেশন করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ও মহান উক্তি “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়” যা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি। বিশ্বমানবতা ও বিশ্ব শান্তির অন্যতম প্রবক্তা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক উক্তিটি এবারই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের প্রস্তাবনায় সন্নিবেশিত হলো।
রাষ্ট্রদূত মুহিত বলেন, শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালেও বাংলাদেশ সেনা/পুলিশ সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে ছিল। বর্তমানে আমাদের শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ৭৩৭০ জন। আমাদের এ অবস্থান বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ এবং আমাদের শান্তিরক্ষীদের উপর জাতিসংঘের গভীর আস্থারই স্বীকৃতি। সাউথ সুদান এর আবেয়ি (অনবুর)-তে আমরা গত বছর হতে শান্তিরক্ষী পাঠানো শুরু করেছি। আমাদের নারী শান্তিরক্ষীদের সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শান্তিরক্ষীদের সার্বিক কার্যক্রমের গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি মিশনের এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বাংলাদেশকে প্রথম অবস্থান বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ২ জন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার, ৪ জন সেক্টর কমান্ডার ও ০১ জন চিফ অব স্টাফ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। বাংলাদেশ উইমেন পিস এন্ড সিকিউরিটি (WPS) Chief of Defence Network এর বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত বলেন, ২০২২ সালে আমাদের মিশন জাতিসংঘের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা/বোর্ডের সভাপতিসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি-বিনির্মাণ কমিশনের ২০২২ সালের জন্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিস বিল্ডিং কমিশনের সদস্য।
বাংলাদেশ ২০২২ সালে জাতিসংঘ উইমেন এর নির্বাহী বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘ উইমেন এর নির্বাহী বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন পর্যালোচনা ফোরামের অগ্রগতি ঘোষণাটি প্রথবারের মতো ২০২২ সালের মে মাসে জাতিসংঘে গৃহীত হয় এবং বাংলাদেশ লুক্সেমবার্গের সাথে এ প্রক্রিয়ার নেগশিয়শনে কো-ফ্যাসিলিটেটর এর দায়িত্ব পালন করে।
এ সময় জানানো হয় যে, ১৭ মার্চ ২০২২ স্বল্পোন্নত দেশগুলির জন্য জাতিসংঘে ২০২২-২০৩১-এই এক দশকব্যাপী দোহা কর্মসূচি গৃহীত হয়। বাংলাদেশ কানাডার সাথে এলডিসি-৫ সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির সহ-সভাপতিত্ব করে এবং দোহা কর্মসূচি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ গত বছর জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় নির্বাচিত হয়েছে। হিউম্যান রাইটস্ কাউন্সিল এ ২০২৩-২৫ মেয়াদে নির্বাচনে জয়লাভ এর অন্যতম। এছাড়াও বাংলাদেশ বর্তমানে কমিশন অব স্ট্যাটাস অব উইমেন -এ ২০১৯-২০২২ মেয়াদে এবং ইউনিসেফ ও ইউএন উইমেন এর নির্বাহী বোর্ড এ ২০১৯-২০২১ মেয়াদে সদস্য ছিল। গত বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘে শান্তি বিনির্মাণ কমিশনে ২০২৩-২৪ মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়াও জাতিসংঘের UNDP/UNFPA/UNOPS এর নির্বাহী বোর্ডের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। এটি বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে একটি দায়িত্ববান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থারই প্রতিফলন।
বাংলাদেশ এ বছর ৫ম বারের মতো জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ৪টি শূন্য আসনের বিপরীতে ৭টি দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যা স্মরণকালে মানবাধিকার কাউন্সিলের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। এই ৭টি প্রার্থী দেশ ছিল আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, বাহরাইন, মালদ্বীপ, দক্ষিণ কোরিয়া, কিরগিজিস্তান ও ভিয়েতনাম। আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও প্রচারণায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে সর্বোচ্চ ১৬০টি ভোট পেয়ে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়।
রাষ্ট্রদূত মুহিত বলেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রবর্তিত একটি বার্ষিক ফ্লাগশিপ রেজুলেশন হল শান্তির সংস্কৃতি। বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম এটি জাতিসংঘে প্রবর্তন করে । সেই থেকে বিগত ২৩ বছর ধরে এটি প্রতি বছর জাতিসংঘে উত্থাপিত হয় এবং বিপুলসংখ্যক সদস্য রাষ্ট্রের কো-স্পন্সরশিপ ও সমর্থনে অনুমোদিত হয়। সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক এই রেজুলেশনের বিভিন্ন দায়বদ্ধতা বাস্তবায়নের ফলো-আপ হিসেবে প্রতিবছর সাধারণ সাধারণ পরিষদে এ সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা আহবান করা হয়। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও জাতিসংঘে ৭ সেপ্টেম্বর একটি উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।